অরুন শীল:: অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। রক্তস্নাত দিনটি বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক এক শোকাবহ দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার অকুতোভয় ভাষা সৈনিক দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে সৃষ্টি করেছিল
এক বিরল ইতিহাসের। সেই ইতিহাস সিদ্ধ মাহেন্দ্র দিন আজকের অমর একুশে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীর আত্ম-পরিচয়ের উৎসবিন্দু। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবী প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং ভাষা ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ৫২‘র ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ (রফিক)। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬০ বছর পর কেমন আছেন রফিকের পরিবার এবং তার স্মৃতি রক্ষার্থে আমাদের পূর্ববর্তী সরকারগুলোই বা কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা জানাতেই ‘খুলনা নিউজ ডটকমের” এর অগণিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে রফিকের জন্মভূমি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার পারিল গ্রাম থেকে সরেজমিনে তৈরী করা হয়েছে এ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন আমাদের মাগুরা জেলা প্রতিনিধি অরুন শীল।
রাজধানী ঢাকা শহরের নিকটবর্তী জেলা মানিকগঞ্জ। এ জেলার সিংগাইর উপজেলার নির্ভৃত পল্লী পারিল বলধারা (বর্তমান নাম কাগজে কলমে রফিক নগর) গ্রামের মরহুম লতিফ মিয়া ও মহহুম রাফিজা খাতুনের জ্যৈষ্ঠ পুত্র ছিলেন আমাদের গৌরব ভাষা সৈনিক রফিক। পারিল গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মরহুম আশ্রাফ উদ্দিন আহমেদ ও বীরেন্দ্র মোহন গুপ্তের প্রিয় ছাত্র রফিক ছিলেন অনেকের মাঝেও তাদের নয়নের মণি। মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই রফিকের মধ্যে দেশপ্রেমের প্রতিফলন দেখা যায় বলে জানালেন তখনকার তার কয়েকজন সহপাঠি। যারা এখনও ৫২‘র দু:সহ স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন। ৫২‘র ভাষা আন্দোলনের সময়েই রফিকের পরিবার রফিকের বিয়ে ঠিক করেন একই গ্রামের রাহেলা খানম পান্নুর সাথে। কিন্তু বিয়ের সানাইয়ের সুর আর শোনা হয়নি ভাষা সৈনিক শহীদ রফিকের। ৫২‘র ২১ তারিখ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ঘাতকের বুলেট ঝাঁজরা করে দেয় তাঁর মাথাসহ সারা শরীর। রেখে যান আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার মর্যাদা আর গৌরবময় দেশের প্রতি ভালবাসার এক অনন্য ইতিহাস। যা আজ বাংলাদেশের সাথে একযোগে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
৬২ বছর পর কেমন আছে ভাষা শহীদ রফিকের পরিবার ?
১৯৫২ সাল থেকে ২০০৯ সাল ৬ দশক। এই ছয় দশক পর কেমন আছে শহীদ রফিকের পরিবার, অথবা শহীদ রফিকের স্মৃতি রক্ষায় পূর্ববর্তী সরকারগুলোই বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা জানতে মুখোমুখি হয় পারিল গ্রামে রফিকের ভাবি মৃত আব্দুল খালেকের স্ত্রী গোলেনূর বেগম (৭৬) এর মুখোমুখি। তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সাথেই জানালেন এদেশের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রতি। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই যত মানুষের দেখা মেলে বলেও জানালেন তিনি। তাঁর ভাষায় সারা বছর কেউ আমাদের খবর রাখেনা। অনেকটা আবেগ তাড়িত হয়ে রফিকের ভাবি গোলেনূর বেগম জানালেন আমরা তো সরকার বা কারো কাছে সাহায্য চায়না। আমরা চায় রফিকের অবদানকে বিশ্ববাসির কাছে স্বমহিমায় তুলে ধরতে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, সরকারিভাবে ৬০ বছরে কিছুই করা হয়নি। মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে রফিকের জন্মভূমি পারিল গ্রামে যোগাযোগের জন্য কোন ভাল সড়ক নেই। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে এর সত্যতা মেলে। দৈনিক মাগুরার এর পক্ষ থেকে পারিল গ্রামে যাওয়ার সময় আমাদের সফরসঙ্গী ছিলেন একুশে টেলিভিশন এবং দৈনিক কালেরকণ্ঠের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি সাব্বিরুল ইসলাম সাবু এবং বাংলাভিশন প্রতিনিধি বিপ্লব চক্রবর্তী। তাদের মটর সাইকেল যোগে পারিল গ্রামে পৌঁছাতেই আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আর অন্যান্য যানবাহনের অবস্থা আরো ভয়াবহ। যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে একবার গেলেও কেই আর আসতে চায়না। স্থানীয় অধিবাসী এবং স্থানীয় সাংবাদিক জানান, বেসরকারি সংস্থা প্রশিকার চেয়ারম্যান ড. কাজী ফারুক নিজস্ব অর্থায়নে এই ঘর (বর্তমানে রফিকের ভাবী গোলেনূর বেগম যেখানে বসবাস করেন) এবং একটি পাঠাগার নির্মাণ করেছেন। তা না হলে এই বাড়ির চিহ্নও এতোদিন মুছে যেত। প্রশিকার তৈরী পাঠাগারের পাশ ঘেঁষে এলাকার যুব/ছাত্ররা চাঁদা তুলে নির্মাণ করেছেন ছোট পরিসরের একটি শহীদ মিনার। যেখানে প্রতি বছর এই দিনে স্থানীয় গ্রামবাসী রফিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। সরেজমিনে দেখা গেছে শহীদ মিনারটি যেখানে নির্মিত তাও যে কোন সময়ে ভেঙ্গে যেতে পারে। ভাষা শহীদ রফিকের আরেক ভাই স্বপরিবারে থাকেন মানিকগঞ্জ শহরের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের সন্নিকটে। আরেক ভাই ঢাকায় বসবাস করেন। রফিকের বাড়ির সন্নিকটে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি লেঃ কর্নেল অবঃ মুজিবর ইসলাম খান তার নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন শহীদ রফিক দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। ২০০৬ ইং সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এখানে বিনামূল্যে এলাকার দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হয়। প্রতি মাসে দুদিন এখানে ওষুধপত্র বিতরণ করা হলেও সেগুলি বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কোম্পানী থেকে অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত।
৬২ বছর পর সরকারি উদ্যোগে জাদুঘর নির্মিত:
মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিক স্মরণে গত ২০০৭ সালে রফিকের বসতভিটার অদূরে পারিল গ্রামে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়েছে রফিক উদ্দিন আহমেদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর ৫৭,১০,০০০/- টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০০৭ সালের ১২ জুন কার্যাদেশ প্রদান করে ১১ অক্টোবর ২০০৭ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও প্রায় ২ বছর পর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে গত ২০০৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশের সকালে ৬০ বছর পর এই পাঠাগার ও যাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
শহীদ রফিকের সহপাঠিরা যা বললেন:
শহীদ রফিকের ২/৩ বছরের সিনিয়র সহপাঠী দেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক পারিল গ্রামের প্রবীণ নিজামউদ্দীন জানান, যে আদর্শ আর লক্ষকে সামনে রেখে রফিক সেদিন মাতৃভাষার আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন সেই ভালবাসার প্রতিদান দিতে আমাদের বিগত সরকারগুলো কেন যেন কুণ্ঠাবোধ করেছেন। তিনি জানান, সরকার যদি প্রথম থেকেই ইতিবাচক কর্মসূচী গ্রহণ করতো তাহলে আজ ভাষা আন্দোলনের ৬২ বছর পর পারিল গ্রামে অনেক কিছুই করা সম্ভবপর ছিল। এই প্রবীন বললেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপান আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন। আর ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক। দীর্ঘ ৬ দশক অতিবাহিত হলেও ভাষা সৈনিকদের প্রতি সরকার বিমাতাসূলভ আচরণ করায় অনেক স্মৃতি আজ বিস্মৃতির অতল হলে হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারিভাবে যা করা হয়েছে তা অনেকটাই দায়সাড়া গোছের। তবে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে স্বল্পতম চেতনা রয়েছে তাও সীমিত পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে বড়ই অভাব বোধ হয়। তিনি অনেকটা ক্ষোভের সাথেই জানালেন, ১৯৫৩ সাল থেকেই এলাকার মানুষ রফিক স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে। তিনি জানালেন, ১৯৫৩ সালের এক মাহেন্দ্র দিনের কথা। প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের সময়ে সারাদেশে পাকিস্তানী জাতীয় সংগীত পাক---বাদ পরিবেশিত হলেও পারিল গ্রামে সেদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ - সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়েছিল। আর সেদিন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী আজকের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নীনা হামিদ পরিবেশন করেছিল জাতীয় সঙ্গীত। তিনি দেশের সকল ভাষা শহীদদের ঢাকায় একই স্থানে সমায়িত করার অনুরোধ জানান । অপরদিকে শহীদ রফিকের জন্মভূমি পারিল গ্রামের এই প্রজন্মের বহু সংখ্যক ছেলেমেয়র কাছে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস নেই। অনেকে জানেই না এই দিনটি কি বা কেন স্মরণ করা হয়। প্রিয় পাঠক, পারিল গ্রামের মানুষের পাশাপাশি আমাদেরও দাবী বর্তমান সরকার ভাষা শহীদ ও অমর একুশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার প্রক্রিয়াটি এখনই শুরু করবেন। অমর একুশের এই প্রতিবেদন তৈরীতে সহযোগিতার জন্য মানিকগঞ্জের সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক এবং পারিল গ্রামের অধিবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তথ্য সুত্রঃ http://www.khulnanews.com/feature/62-featured-news/50620-parile-grame-akdin.html