বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারিক শাস্তি
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড এবং পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতি থেকে বিরত রাখার শাস্তি দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত।ইমরান খানের জনপ্রিয়তা না কমলেও তার প্রথম গ্রেফতারির পর পাকিস্তানের পথে পথে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিল তা এবার দেখা যায়নি।প্রথমবার জনতার আবেগ ছিল অনিয়ন্ত্রিত, পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমন করে বিক্ষুব্ধ জনতা ভাংচুর চালিয়েছে, আগুন লাগিয়েছে।ইমরান খান নির্বাচনে লড়াই করার ক্ষমতা হারিয়ে দলের প্রধানের পদও হারাতে চলেছেন বলে মনে হয়। ইমরান খান ছাড়াও ইউসুফ রাজা গিলানি ও নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল আদালত।তবে ইমরান খান অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন ক্ষমতা হারানোর ১৬ মাস পর।পাকিস্তানের বিষাক্ত রাজনীতি তলানিতে নেমেছে; ইমরান খান আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, কারাগারে তাকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হতে পারে।
সাংবিধানিক পদে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নিয়ম হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থাকে যে সকল উপহার পাবেন সেগুলোর নথিভুক্ত করে সরকারের তোষাখানায় জমা দিতে হবে।প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইমরান খান যে সকল উপহার পেয়েছিলেন তা সরকারের তোষাখানায় জমা না দিয়ে দুবাই মার্কেটে ১৪ কোটি রুপির বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।এই জঘন্য অপরাধ ঢাকার জন্য তিনি আবার ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে তা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন।অবশ্য ইমরান খানের বক্তব্য অনুযায়ী অর্ধেক মূল্য দিয়ে তিনি উপহার সামগ্রী কিনে নিয়েছিলেন।এসব উপহারের মধ্য রয়েছে হীরার অলংকার, বালা ও হাতঘড়ি ইত্যাদি। হাতঘড়িটি দিয়েছিলেন সউদি যুবরাজ। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দেওয়া পিস্তলও প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সরকারি তোষাখানায় জমা দেননি, জমা না দেওয়ায় বিষয়টি আদালতে ঊঠেছিল।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে, তার মধ্যে দুর্নীতির মামলা অনেকগুলো।রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারি নথি ফাঁস করে জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার অভিযোগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ১৪ বছর জেল হতে পারে।অনুরূপ আরেকটি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তার ফ্লোরিডার বাসা থেকে ১১ হাজার সরকারি নথি উদ্ধার করা হয়েছে।এই নথিগুলোর মধ্যে অতি গোপনীয় নথিগুলো বিদেশি শত্রুর হাতে পড়লে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ক গোপনীয় নথি নির্ধারিত রক্ষণাগারের বাইরে আনার ক্ষমতা খোদ প্রেসিডেন্টেরও নেই। এছাড়াও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা একের পর এক দায়ের হচ্ছে; কিন্তু ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা মনে করেন, ট্রাম্পকে পরিবর্তী নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই সকল মামলা করা হচ্ছে।ট্রাম্পের কোন অপরাধই তার সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থায় তার সমর্থকদের মধ্যে সহিংস আক্রমণের প্রবণতাও বেড়ে গেছে।ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিক দলের মধ্য সম্পর্ক এখন অনেকটা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো; আমেরিকায় আগামী নির্বাচনের ফলাফল কোন একটি দলের পছন্দ
মাফিক না হলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ঢালাও অভিযোগ হচ্ছে বিচারের রায় শাসকের কথামত চলে; ইমরান খান যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তার কথামত চলতো।এখন ইমরান খানের সমর্থকরা মনে করছে, ইমরানকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে সরকার বিচারালয়কে কাজে লাগিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করছে।বিচারের রায় নিয়ে বিরোধী দলের এমন ঢালাও মন্তব্য ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশে শোনা যায়।অথচ প্রথমবার গ্রেফতারের সাথে সাথে জামিন হয়ে গেলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিচারক ও বিচারালয় ইমরান খানের অনুকূলে কাজ করছে, তখন ইমরান খানের সমর্থকগণ বিচারকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল।রায় বিপক্ষে গেলেই রায় নিয়ে কটাক্ষ শুরু হয়।যারা রায়ের কঠোর সমালোচনা করছেন তারা কেন বলছেন না, একজন প্রধানমন্ত্রী তোষাখানার উপহার সামগ্রী বিক্রি করে আইন বিরোধী, অর্থের লোভে নৈতিকতা বিরোধী কাজ করেছেন।উপহার সামগ্রীর মূল্যমান মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হচ্ছে একজন প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যা কথা বলা উচিত নয় বা তিনি মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করতে পারেন না।
পশ্চিমের দেশগুলোতে পারষ্পরিক সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক কোন অপরাধ নয়; কিন্তু তা যদি কোন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী করেন তা জনগণ সহ্য করে না।এই ক্ষেত্রে শাস্তি হয় মিথ্যা বয়ান দিলে।বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বিয়ে না করেও বান্ধবীকে নিয়ে ঘর-সংসার করেছেন, তাদের নবজাত সন্তানকে নিয়ে সারা বৃটেনবাসী আনন্দ করেছে।কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন মনিকা লিউনস্কির সাথে প্রেমের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, পরে সত্য স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন।তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় প্রধানের কোন অপরাধকেই দলীয় সমর্থকরা বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করলেও অন্য নাগরিকের গুরুতর অপরাধের সাথে তুলনা করে হাল্কা করার চেষ্টা হয়।
একই ঘটনা ঘটছে ভারতের রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে।নেতাদের লাগাম ছাড়া কথাবার্তা মানব সমাজকে কলুষিত করছে। ভারতে ২০১৯ সনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে এক নির্বাচনী প্রচারণায় রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ‘সব চোরেরা কেন তাদের পদবিতে মোদী ব্যবহার করে? নিরাভ মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদী’। ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির পুর্ণেশ মোদী নামের এক আইন প্রণেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলা করে উল্লেখ করেন যে, রাহুল গান্ধীর মন্তব্য সমগ্র মোদী সম্প্রদায়ের জন্য মানহানিকর। মানহানির ফৌজদারি মামলায় রাহুল গান্ধীর ২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।কলামের আলোচ্য বিষয় শাস্তি নয়, শাস্তির পর রাহুল গান্ধীর বেড়ে যাওয়া জনপ্রিয়তা।বিচারিক আদালতের রায়ের উপর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ হওয়ার সাথে সাথে কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের সাথে জোটের শরীক দলের সমর্থকদের মধ্যে উল্লাস আর উচ্ছ্বাসের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, ‘মোদি’ নামের সবাইকে অপমান করার কথা কেউ বলছে না।
বাংলাদেশেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
দুর্নীতি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। বৈধ আয় বহির্ভূত ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ২ কোটি ১৬ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০০৭ সনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা মামলা।বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলায় তাদের নেতার বিরুদ্ধে সাজানো রায় হচ্ছে।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধও মামলা হয়েছিল, সব মামলা তুলে নেয়া হয়েছে।বিএনপি’র বক্তব্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিয়ে বিএনপি নেতাদের সেই সময়ের মামলায় শাস্তি দেওয়া অন্যায় ও অযৌক্তিক।এছাড়াও একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত নেতারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন।আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ নেতাদের বিরুদ্ধেও বলতে হবে এবং ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচারও করতে হবে।কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের অপরাধের সাথে তুলনা করে নিজ দলের নেতাদের অপরাধকে গৌণ করে দেখা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সামিল।
আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগ নেতার, বিএনপির আমলে বিএনপি নেতার দুর্নীতির দায়ে শাস্তি হয়েছে এমন নজির খুব বেশী নেই।সব নেতাই দলীয় সমর্থকদের চোখে নিষ্পাপ, অথচ এই দলীয় সমর্থকরা আবার দুর্নীতি ও ফৌজদারি মামলার বিচার চায়।’সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল
ahmedzeauddin0@gmail.com
https://sangbad.net.bd/opinion/post-editorial/102387/