খুনিদের তুলে আনার প্রস্তাবে রাজি হননি শেখ হাসিনা | প্রথম পাতা | কালের কণ্ঠ

MS ISLAM _ BDTutorials2
0


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক খুনিদের টাকার বিনিময়ে অপহরণ করে বাংলাদেশে তুলে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই বিদেশি এজেন্ট। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করা যাবে না বলে মত দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের সমন্বয়ক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানান।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানকে সেই টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক নিয়োগ করা হয়। খুনিদের ফিরিয়ে আনার তৎপরতার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করতেন। শোকাবহ ১৫ আগস্টের প্রাক্কালে গতকাল দীর্ঘ আলাপচারিতায় তাঁর কাছ থেকে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেই টাস্কফোর্স যেসব তৎপরতা চালিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ।   
ওয়ালিউর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বিদেশি এজেন্টদের দেওয়া ওই প্রস্তাবের কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন তিনি ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা-  এনএসআইয়ের মহাপরিচালক কাজী মশিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী তখন এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানতে চান। তাঁরা ‘না সূচক’ মতামত দিলে শেখ হাসিনাও বলেন, এটা করা উচিত হবে না। আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে যাওয়া যাবে না। খুনিদের ফিরিয়ে আনার স্বাভাবিক যে প্রক্রিয়া তা-ই অনুসরণ করতে হবে।
তবে কোন খুনি বা খুনিদের ফিরিয়ে আনতে বা কোন বিদেশি এজেন্টরা কত টাকার বিনিময়ে ওই কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন- ওয়ালিউর রহমানের কাছে এসব তথ্য জানতে চাওয়া হলে ‘বিষয়গুলো স্পর্শকাতর’ বলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বর্তমান টাস্কফোর্সে ওয়ালিউর রহমান নেই আর কাজী মশিউর রহমান গত বছর মারা গেছেন। 
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর একই পরিণতির শঙ্কায় আরো ছয় খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা হলেন লে. কর্নেল (বরখাস্ত) নূর চৌধুরী, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। তাঁদের মধ্যে নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। খুনি আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। এ ছাড়া লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ লিবিয়ায় ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তানে ছিলেন এবং বাকিরা ঘন ঘন অবস্থান পাল্টাচ্ছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে সরকার জানতে পেরেছে। ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে পালিয়ে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
খুনিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ যেভাবে শুরু : ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া। শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে শুরু হয় বৈঠক। তাদের দায়িত্ব ছিল সপ্তাহে এক বা দুই কিংবা প্রয়োজনে প্রতিদিনই বৈঠক করে কৌশল, কাঠামো ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সেখানেই একপর্যায়ে সমন্বয়ক ঠিক করা হয় রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানকে।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, খুনিদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই সমালোচনা আসে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আইনি কাঠামো নিয়ে পুস্তিকা বের করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রেও মৃত্যুদণ্ড আছে। এ দেশে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ কেউ করলে তারও সেই দণ্ড হতে পারে।
সমন্বয়কের দায়িত্ব ছিল খুনিরা থাকতে পারেন এমন দেশগুলোতে গিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া। ওয়ালিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এনএসআইয়ের মহাপরিচালক কাজী মশিউর রহমানকে। তিনিই বিভিন্ন দেশে এজেন্ট নিয়োগ করে খুনিদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ রাখতেন।
থাইল্যান্ড থেকে বজলুল হুদাকে ফিরিয়ে আনতে চুক্তি : পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ যখন চলছিল তখনই থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তার হন বজলুল হুদা। বাংলাদেশ তাঁকে ফেরত পেতে চায়, থাইল্যান্ডও দিতে চায়। দুই পক্ষের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হুদাকে ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে বেশ কয়েকবার ব্যাংককে যান টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক।
অন্য খুনিদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কেও তথ্য পেয়েছিল সরকার। তথ্য আসে যে ইতালির মিলানে খুনি কর্নেল রশিদের নামে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্য খুনিরা এসে বৈঠক করতেন। লন্ডনের দক্ষিণেও রশিদের নামে আরেকটি বাড়ি ছিল।
পাশাকে ফেরতের বিনিময়ে অর্থ চান মুগাবে : ওয়ালিউর রহমান আরো জানান, সে সময় জিম্বাবুয়েতে অবস্থানরত খুনি আজিজ পাশাকে ফেরত পেতে সহযোগিতার জন্য ওই দেশের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ চান তিনি ও কাজী মশিউর রহমান। সাক্ষাৎদানের সুযোগের বিনিময়ে মুগাবের সচিব তাঁদের প্রেসিডেন্টের দাতব্য তহবিলে এক হাজার ডলার দেওয়ার জন্য বলেন। তখন তাঁরা জিম্বাবুয়ে থেকে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা চান। শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত পেয়ে জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস (বর্তমানে নেই) থেকে ওই অর্থ দেওয়া হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট মুগাবের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশকে জানানো হয়, অর্থ দিলে আজিজ পাশাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া হবে। সেই কথাও তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর পর তিনি তাতেও রাজি হন। জিম্বাবুয়ের পক্ষ থেকে হস্তান্তরের তারিখ ও স্থান জানানো হয়। কিন্তু এরপর বাংলাদেশই পিছিয়ে আসে।
সাড়া মেলেনি কেনিয়ায় : খুনি শরিফুল হক ডালিম কেনিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন- এমন খবর পেয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা কেনিয়ায় গিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ডালিমের বিচারের জন্য তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দিলে তাঁরা তেমন সাড়া দেননি। তবে ইতালি ও যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী যথাক্রমে মিলান ও লন্ডনে কর্নেল রশিদের নামের বাড়ি দুটি সিলগালা করে দেয়।
রাষ্ট্রদূতের নিষ্ক্রিয়তায় জার্মানি ছাড়েন নূর চৌধুরী! : ওয়ালিউর রহমান অভিযোগ করেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে জার্মানিতে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই নূর চৌধুরী ওই দেশ ছাড়তে সক্ষম হন। এরপর নূর চৌধুরী লিবিয়া হয়ে কানাডায় চলে যান। এখনো তিনি সেখানে আছেন। জানা গেছে, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠালে বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আশঙ্কা থাকায় কানাডা সরকার তাঁকে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী নয়। এর পরও নূর চৌধুরীকে ফেরত পেতে বাংলাদেশ সরকারের জোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকায় কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে ‘ভয়ংকর অপরাধ’ বললেও তাঁর দেশের গোপনীয়তা আইনের ‘অজুহাতে’ খুনি নূর চৌধুরী সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।
রশিদকে আনতে গিয়ে প্রতিনিধিরা বিপাকে : সরকারের কাছে খবর ছিল যে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের বেশির ভাগই আছেন লিবিয়ায়। তাঁদের নেতা হিসেবে ছিলেন কর্নেল রশিদ। তিনি থাকতেন বেনগাজিতে। লিবিয়ার পার্লামেন্টের তৎকালীন স্পিকার আবদুর রহমান আল শালদাম ছিলেন রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানের পুরনো বন্ধু। রশিদকে ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতার অনুরোধের জবাবে স্পিকার আবদুর রহমান তাঁদের লিবিয়ায় যেতে বলেন। স্পিকার নিশ্চিত করেছিলেন যে তিনি লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন। এরপর রশিদকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা দেশে ফিরতে পারবেন।
ওই আশ্বাস পেয়ে ওয়ালিউর রহমান ও কাজী মশিউর রহমান ইতালি থেকে মাল্টা হয়ে লিবিয়ায় ঢোকার পরিকল্পনা করেন। মাল্টা থেকে সকালে জাহাজযোগে লিবিয়ায় যাওয়ার আগে মধ্যরাতে মাল্টার পুলিশ কমিশনার সদলবলে এসে তাঁদের জানান, এখনই তাঁদের হোটেল ছাড়তে হবে। কারণ তাঁদের হত্যার জন্য রশিদ দুই ঘাতককে পাঠিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মাল্টার পুলিশ হোটেলে বাংলাদেশের ওই দুই প্রতিনিধির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ওয়ালিউর রহমান জানান, তাঁরা পুলিশ কমিশনারের অতিথিকক্ষে রাত্রি যাপন করে পরদিন সকালে লিবিয়া না গিয়ে ইতালিতে চলে আসেন। তিনি বলেন, রশিদের গতিবিধি জানার জন্য বাংলাদেশ যেমন চর নিয়োগ করেছিল, তেমনি রশিদও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে চর নিয়োগ করেন। তাঁদের মাল্টা হয়ে লিবিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতির খবর রশিদ আগেই জেনে যান।
উদ্যোগে হঠাৎ স্থবিরতা : মুগাবের কাছে প্রত্যাশিত অর্থ বাংলাদেশ পৌঁছে দিয়েছিল কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান জানান, এর আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁদের এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ওই পর্যায়ের উদ্যোগ থামানোর পক্ষে মত দেন।
ওয়ালিউর রহমান বলেন, তাঁদের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতার বিষয়ে তাঁরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাতেন। কৌশলগত কারণে সব কাজ হতো গোপনে। এমনকি দূতাবাসগুলোও অনেক ক্ষেত্রে কিছু জানত না। অর্থের জোগান মিলত প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে। পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই টাস্কফোর্স বন্ধ হয়ে যায়।
ওয়ালিউর রহমান বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হয় অত্যন্ত গোপনে। ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে খুনিদের ফিরিয়ে আনা হবে- এ রকম প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ফল পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে কৌশলী নীতি ও দৃঢ়চেতা জনবল প্রয়োজন।
সক্রিয় টাস্কফোর্স, ফেরেনি কোনো খুনি : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ছয় খুনিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। টাস্কফোর্সও জানে না কবে নাগাদ খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে। কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে দেশ দুটিকে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে অনুরোধ জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, খুনিদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোই বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন উদ্যমে এ ব্যাপারে জোরালো প্রয়াস চালছে। খুনিদের আশ্রয় দেওয়া দেশগুলোকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমরা আপনাদের আইনকে সম্মান করি। আপনাদেরও অবশ্যই আমাদের আইনকে সম্মান করতে হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘খুনিদের ফেরত পাঠাতে প্রথমত তাঁদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোর নীতিগত সম্মতিই জরুরি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। আশ্রয়দাতা দেশগুলো এর আগে আসামি ফেরত দিয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। অব্যাহতভাবে কাজ করব এবং প্রয়োজনে সরকারি বলয়ের বাইরেও সহায়তা নেব আন্তর্জাতিকভাবে, যেন তারা প্রয়োজনে তাদের দেশের আইন পরিবর্তন করে হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়।’
মন্ত্রীদের ব্যস্ততায় হয়নি টাস্কফোর্সের গতকালের বৈঠক : খুনিদের ফিরিয়ে আনতে আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকও গতকাল অনুষ্ঠিত হয়নি। টাস্কফোর্সের প্রধান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৈঠক না হওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় এ বৈঠক হয়নি। তবে শিগগিরই বৈঠক হবে বলে তিনি জানান।
পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা আন্তরিক। তবে আমাদের স্রোতের বিপরীতে কাজ করতে হচ্ছে। খুনিদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। তাঁকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সে দেশের সরকারকে বলা হয়েছে। তারা বলেছে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্সের বৈঠক তিন মাস পরপর হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়মিত হচ্ছে না। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের পর গত এপ্রিলে সর্বশেষ বৈঠক হয়।
যেভাবে দেশ ছাড়েন খুনিরা : ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যার পরদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) হয়ে থ্যাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক চলে যান। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকারের পাঠানো বিশেষ বিমানে করে তাঁদের লিবিয়ায় পাঠানো হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুর ১২ খুনিকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়।
নূর চৌধুরী নিয়োগ পান ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে। এরপর তিনি ব্রাজিলে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ সরকারের সময় তাঁকে আলজেরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেশ কিছুদিন জার্মানিতে অবস্থানের পর এই খুনি অনেক দেশ ঘুরে কানাডায় গিয়ে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস ২০০৭ সালে নূর চৌধুরীর নামে পাসপোর্ট ইস্যু করে। সে সময় কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন খন্দকার মোশতাকের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে রফিকুল ইসলাম টিপু। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশন তাঁর নামে ইস্যু করা পাসপোর্ট বাতিল করে। নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় নজরদারিতে রয়েছেন। শরণার্থী হিসেবে বসবাসের জন্য তাঁর আবেদন ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
খুনি ডালিম ২০০৯ সালের শেষ দিকে কানাডায় গিয়েছিলেন বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। জানা গেছে, কানাডা থেকে কয়েক দিন পরই তিনি হংকং হয়ে আবার পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন বলে ধারণা করা হয়।
লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে অনুরোধ জানিয়ে সরকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০১০ সালে চিঠি পাঠায়। সূত্র জানায়, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চৌধুরী এ এম রাশেদ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে হত্যা করেন। একই বছরের ৩ নভেম্বর ওই গ্রুপ বাংলাদেশের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ মো. নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সাবেক দুই মন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারাগারে আটক অবস্থায় হত্যা করে। রাশেদের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ধানমণ্ডি থানায় দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৩০২, ৩২৪, ৩০৭, ১০৯ এবং ৩৪ নম্বর ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২ আগস্ট মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর লালবাগ থানায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায়ও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৯৯৬ সালের ৯ আগস্ট চৌধুরী এ এম রাশেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বাংলাদেশের অনুরোধের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ফল মেলেনি।

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/08/15/117289#sthash.ygK4zSjh.dpuf

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)