মানিকগঞ্জের ঐতিহাসিক ফোর্ড নগরী

MS ISLAM _ BDTutorials2
0


…….অধ্যক্ষ শফিউদ্দিন আহমদ  
সিংগাইর উপজেলার ফোর্ড নগরী এবং তোপখোলা বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক স্থানবাস্তবে এ নগরীদ্বয়ের কোন নিদর্শন আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না কারণ এর প্রাসাদ অট্টালিকা, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য স্থাপত্যশিল্প প্রমত্তা ধলেশ্বরীর গর্ভে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছেগোড়াপত্তনের অল্পকাল পরেইধ্বংসপ্রাপ্তির ফলে সম্ভবতঃ এ নগরীদ্বয় সমসাময়িক ইতিহাসত্তাদের নজরে আসেনিএবং এ যাবৎ খুঁজে পাওয়া যায়নি এর প্রকৃত তথ্যপূর্ণ প্রামান্য ধারাবাহিক ইতিহাস নগরী বহুদিন টিকে থাকলে অবশ্যই এর সন্নিকটবর্তী অন্যান্য নগরী ও দুর্গের মত অন্ততঃ ইতিহাসের পাঞ্জায় স্থান পেতফোর্ড নগরী ও তোপখানা শুধুমাত্র এর নামের মধ্যেই স্মৃতিময় ইতিহাসের রূপরেখা ধারণ করে চলেছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ফোর্ড নগরী সিংগাইর উপজেলার উত্তরপূর্ব প্রান্তে অবস্থিত মানচিত্রে ফোর্ড নগরীর নাম উল্লেখ থাকলেও তা ফুডনগর বা ফুটনগর হিসেবেই বর্তমানে এলাকার অধিবাসীদের কাছে পরিচিতআজকের চরাঞ্চলের ফুডনগরীতে যারা ব্যবসা করছে তারা হয়ত ভাবতেই পারবে না এ এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছিল, ছিল জনবহুল নগরীর গৌরবময় মর্যদা
পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় বড় নগরী এবং দুর্গ নগরীতে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সামরিক উপকরণ, রসদ ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের জন্য কাছাকাছিতেই গোলাঘর বা তোপখোলা নির্মাণ করা হতোউদাহরণ স্বরূপ প্রাচীন  ঢাকা নগরীর লালবাগ দুর্গ এবং তোপখোলার ( বর্তমানে তোপখানা হিসাবে পরিচিত ) কথা উল্লেখ করা যেতে পারেঅনুরূপভাবে গুরুত্বানুযায়ী ফোর্ড নগরীর কাছাকাছি তোপখোলা নির্মিত হয়েছিলইতিহাস সচেতন যে কোন ব্যক্তিই ফোর্ড নগরী ও  তোপখোলার অবস্থান দেখলেই এর বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন ফোর্ড নগরী অবস্থান প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসেবে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ ধারণা অনেকাংশে সত্য এ নগরীর গোড়াপত্তনের পেছনে সামরিক প্রতিরক্ষাজনিত পরিকল্পনা বিদ্যমান ছিলধলেশ্বরী এবং বংশী নদীর প্রাচীন ও বর্তমান প্রবাহ এবং এ নদীদ্বয়ের সঙ্গে দেশের অপরাপর নদনদীর সঙ্গে সংযোগের দিকে ল্ক্ষ্য করলেই এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিরূপন সহজতর হবে ধলেশ্বরী বর্তমানে যমুনার শাখা নদী হিসেবে বাহিত হলেও মূলতঃ এটা প্রাচীন গঙ্গার পরিত্যক্ত খাতবিভিন্ন সময়ে ধলেশ্বরী বিচিত্রভাবে তার খাত ও গতিপথ পরিবর্তন করেছেধলেশ্বরীবাহিত খাতের মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার গৌড়, লক্ষ্মণাবতী, রাজমহল মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি বিখ্যাত রাজধানী নগরের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় ঢাকা বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, ধামরাই, সাভার, চিটাগাং প্রভৃতি নগরও দুর্গ নগরীর প্রত্যক্ষ নৌ-সংযোগ বিদ্যমান ছিল

বংশী নদী প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখাব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ বিভিন্ন সময়ে খাত পরিবর্তন করলেও বংশীর প্রবাহ বরাবরই নাব্য ছিল এবং এটা বর্তমানে সিংগাইর থানার উত্তরপূর্বে এবং সাভারের সন্নিকটে ধলেশ্বরীতে মিলেছেবংশী নদীর খাত দিয়ে সমগ্র উত্তর এবং উত্তরপূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা-সোনারগাঁও সহ দণিাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ উন্নত জনপদের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ করা করা সম্ভব ছিলএই বংশী নদীর তীরে ধামরাই, গোরী, গনকপাড়া, গুড়ীপাড়া, পাঠানতলীতে আফগানদের শক্তিশালী দুর্গ এবং সাভারের নিকট কাটিবাড়ীতে রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানী ছিলফোর্ড নগরী থেকে এগুলোর দূরত্ব খুবই নিকটবর্তী, কাজেই সামগ্রিক ভাবে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের সম্ভাব্য আক্রমণ বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলা দমন এবং প্রতিরোধকল্পে বিশাল ধলেশ্বরী এবং বংশী নদীর জলপথ  নিয়ন্ত্রণের জন্য ফোর্ড নগরী ছিল সর্বোত্তম স্থান বংশী এবং ধলেশ্বরীর মিলিত প্রবাহ ফোর্ড নগরীকে রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেকিন্তু পূর্বে ঠিক এ অবস্থা ছিল নাএটা রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানীর অন্তর্ভূক্ত ছিলধলেশ্বরী ও বংশীর প্রবাহ সেকালে কিছুটা ভিন্ন খাতে বাহিত হতোস্থানীয় জনশ্রতি অনুযায়ী রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানী শহর জাকজমকপূর্ণ এবং কাটিবাড়ী হতে বাংলার পূর্ব দক্ষিণ তীর বরাবর সিংগাইর উপজেলা সদরের কাছাকাছি ধলেশ্বরীর তীর ভাকোম পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিলরাজধানীর উত্তরে কাটিবাড়ীতে এবং দণি পশ্চিমে বর্তমান ফোর্ড নগরের অবস্থানে দুটি বড় ধরণের দুর্গ ছিলরাজা হরিশ চন্দ্রের আদি বাস ছিল বিক্রমপুরেতিনি বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন এবং পরে সাভারের নিকট কাটিবাড়ীতে গমন করেনস্যার উইলিয়াম হান্টার  তাঁর Statistical account of Bengal [vol. v, page 118, 1875]  গ্রন্থে মিঃ এ. এল. কের রিপোর্টের বরাত দিয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,
‘The Bhuiya or Budd’st Rajas (Founder of pal dynisty of the kings of
bengal) are the next rulers spoken of. There of them took up their abode
in this district, to the worth of the Buriganga and Dhaleswari, where
the sites of capitals are still to be seen, Jas pal resided at Madhabpur
in Talifabad : Harisch andra at Katibari, near Savar ; and Sisu Pal at
Kapasia in Bhawal

ধামরাই উপজেলার বিখ্যাত রথযাত্রা উপলক্ষে ১৯৫২ সনে প্রকাশিত ধর্মরাজিকা নামক ছোট ম্যাগাজিনে জনৈক জ্ঞানপ্রসাদ ভৌমিক ঐতিহাসিক নগরী ধামরাই শীর্ষক প্রবন্ধে বোকাই নগরে প্রাপ্ত একটি শিলালিপির উদ্বৃতি দিয়ে ফোর্ড নগরীকে শক্তিশালী আফগান প্রতিরোধ ঘাঁটি হিসেবে সনাক্ত করেছিলেনফোর্ড নগরীসম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ইতিহাস বিখ্যাত ধামরাই শহর হইতে প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বংশী এবং ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলের নিম্নভাগে অবস্থিত ছিল ঐতিহাসিক ফোর্ড নগরীএই গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই আফগানরা স্থাপন করিয়াছিলেন তাহাদের প্রথম প্রতিরোধ ঘাটিকিন্তু উক্ত প্রতিরোধ ঘাটি দীর্ঘদিন টিকিয়া থাকে নাইবুভুক্ষু ধলেশ্বরী ফোর্ড নগরী গ্রাস করিয়াছিল সেই সপ্তদশ শতকের গোড়াতেইঅতঃপর আফগানগণ বংশী নদীর তীরবর্তী বোকাই নগরে স্থাপন করিয়াছিল তাহাদের দ্বিতীয় প্রতিরোধ ঘাটিবোকাই নগরেও বর্তমানে আফগানদের কোন স্থাপত্য নিদর্শন নেইফোর্ড নগরীরচরাভূমিতে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে পর্তুগীজদের ঘাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জানা যায়কোম্পানী শাসনের গোড়ার দিকেই উক্ত স্থান হতে পর্তুগীজদের অপসারণ ঘটেপ্রাচীন ফোর্ড নগরীর পার্শ্ববর্তী কাটিবাড়ীতে রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানীরও কোন স্থাপত্য নিদর্শন এখন অবশিষ্ট নেইরাজা হরিশ চন্দ্র কাটিবাড়ীতে তার রাজধানী স্থাপন করেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠা করেন এবং ভাকোম পর্যন্ত রাজধানী শহরের সীমা বর্ধিত হয়ফোর্ডনগরীর প্রাচীন নাম কি ছিল অথবা কিভাবে এ নামের উৎপত্তি ঘটেছে জানা যায়নি ফোর্ড নগরী হতে ধামরাই ও গনকপাড়ার দূরত্ব অল্প; রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্র (রাজ প্রাসাদ) প্রায় দেড় মাইল এবং ঢাকা ও সোনারগাঁও যথাক্রমে ১১ এবং ২০ মাইল

তবে Topography of Dacca গ্রন্থে স্যার জেমস টেলর ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানীর ধ্বংসস্তুপ ল্যক্ষ করার কথা উল্লেখ করেছেনইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যুদ্ধ বিগ্রহ ব্যতিরেকেও নদীর নাটকীয় গতিপথ পরিবর্তন এবং ভাঙ্গনের মুখে বহু ইতিহাস বিখ্যাত নগর জনপদ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছেপ্রাচীন সোনারগাঁও, রাজনগর, শ্রীপুর, যাত্রাপুর, জাফরগঞ্জ, বাঙ্গেলা এবং ধলেশ্বরীর তীরবর্তী পুরানো মানিকগঞ্জ শহর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণধলেশ্বরী এবং বংশী নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গন এবং প্রবাহে বর্তমান রূপ লাভ করলেওকোম্পানী শাসনামলে মহকুমা স্থাপনের প্রেক্ষিতে আজকের ফোর্ড নগরী মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়

বিশ শতকের শেষে পৌঁছে ফোর্ড নগরী আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছেজনজীবনেচঞ্চলতা বয়ে যাচ্ছে আপন গতিতেকিন্তু ফোর্ড নগরীর ইতিহাস আজো রয়ে গেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং রহস্যাবৃত্ত এ নগরীর সঙ্গে তৎকালীন রাজনৈতিক পতনের কেন্দ্রভূমি বিক্রমপুর, ঢাকা, সোনারগাঁও, সাভার, ধামরাই, কাটিবাড়ীর সঙ্গে রাজনৈতিক বা সামরিক সম্পর্ক এবং পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্রীয় মতার উত্থান পতনে এর কোন অবদান রয়েছে কিনা আজকে আধুনিক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা দ্বারা নির্ণয় করা প্রয়োজনঐতিহ্যেরঅনুসন্ধান সমাজ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপধ্বংসপ্রাপ্ত অখ্যাত ফোর্ড নগরী ও তোপখোলার সঠিক গোড়াপত্তন এবং তৎসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক উপাদান উদ্ধার করতে পারলে মানিকগঞ্জের তথা সমগ্র দেশের আঞ্চলিক ইতিহাস নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধশালী হবে

(লেখকঃ   ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক এবং অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ভূঞাঁপুরটাঙ্গাইল স্থায়ী ঠিকানা: 1/1 গংগাধর
পট্টি,থানা রোড়, মানিকগঞ্জ।) 
তথ্য সুত্রঃ জাগো মানিকগঞ্জের সৌজন্য  http://www.zagomanikganj.com/?p=290

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)